Saturday, June 3, 2023
Homeঅর্থনীতিমুদ্রাস্ফীতি কি? মুদ্রাস্ফীতি কেন ঘটে ও নিয়ন্ত্রণের উপায়?

মুদ্রাস্ফীতি কি? মুদ্রাস্ফীতি কেন ঘটে ও নিয়ন্ত্রণের উপায়?

মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক চিত্র। তবে বড় ধরণের মুদ্রাস্ফীতির অর্থনীতির জন্য অভিশাপ ডেকে আনে। মুদ্রাস্ফীতি বলতে সাধারণত পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়াকে বুঝানো হয়। যা মূলত অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে ঘটে থাকে। আজকের আর্টিকেলে আমি মুদ্রাস্ফীতি কি? মুদ্রাস্ফীতি কেন ঘটে ও নিয়ন্ত্রণের উপায়? মুদ্রাস্ফীতির প্রকার, লাভ ক্ষতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। তাহলে আর দেরি না করে চলুন এসব সম্পর্কে জেনে নেই।

মুদ্রাস্ফীতি কি? মুদ্রাস্ফীতি কেন ঘটে ও নিয়ন্ত্রণের উপায়?
মুদ্রাস্ফীতি কি? মুদ্রাস্ফীতি কেন ঘটে ও নিয়ন্ত্রণের উপায়?

মুদ্রাস্ফীতি কি?

যেকোন দেশের বাজারে পণ্যের মজুদ এবং মুদ্রার পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। যদি পণ্যের তুলনায় মুদ্রার সরবরাহ অনেক বেশি বেড়ে যায় অর্থাৎ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত মাত্রায় টাকা ছাপায়, সাধারণত তখনি মুদ্রাস্ফীতি ঘটে থাকে। একারণে একই পরিমাণ জিনিস কিনতে আপনাকে আগের চেয়ে বেশি মুদ্রা খরচ করতে হবে। তার মানে হলো জিনিষপত্রের দাম আগের চেয়ে বেড়ে যাবে। অর্থাৎ ওই মুদ্রার মান কমে যাবে।

আরও সহজভাবে বলা যায় যে, মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে উপলব্ধ অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে সময়ের সাথে সাথে মূল্য বৃদ্ধি। এক কথায় বলা যায় যে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে আপনি আগের চেয়ে এখন অনেক কম জিনিস কিনতে পারবেন। চলুন একটি উদাহরণের মাধ্যমে জেনে নেই।

মনে করুন, গতবছর ১০০০ টাকা দিয়ে আপনি ২০ কেজি চাউল কিনতে পারতেন। কিন্তু চলতি বছর বা বর্তমানে সেই একই পরিমাণ চাউল ১০৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে আপনার ৫০ টাকা বা ৫% বেশি টাকা লাগছে। আর এই ৫% হল মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ। এর অর্থ হলো টাকার মানও ৫% কমে গেছে।

ঠিক এভাবেই একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দামের পরিবর্তন হিসাব করে মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপ করা হয়ে থাকে।

বিভিন্ন অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মুদ্রাস্ফীতি যদি ওই দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির চেয়ে কম থাকে তাহলে সেটার তেমন নেতিবাচক প্রভাব থাকে না।

মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ যদি ২-৫% হয় তাহলে সেটাকে সহনীয় মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়। আর ৭-১০% হলে মধ্য ও নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়ে যাবে। আর মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ যদি এর চেয়েও বেশি হয় তাহলে সেটা পুরো দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এটা মূলত সে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার উপর নির্ভর করে থাকে।

আবার, অল্প কয়েকটা পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়লেই তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা যাবে না। কেবল যদি সামগ্রিকভাবে পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়ে তাহলে তখন বুঝে নিতে হবে যে মুদ্রাস্ফীতির কারণে এমন হয়েছে।

মুদ্রাস্ফীতি কাকে বলে? এ সম্পর্কে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদদের সংজ্ঞা

উপরে আমরা মুদ্রাস্ফীতি কি? এ সম্পর্কে জেনেছি। এবার আমরা মুদ্রাস্ফীতি কাকে বলে? এ সম্পর্কে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদদের সংজ্ঞা সম্পর্কে আলোচনা করব।

যখন কোন দেশে প্রচলিত অর্থের পরিমাণ উৎপাদিত মোট দ্রব্যের তুলনায় বেশি হয়, যার ফলে দ্রব্যমূল্য ক্রমেই বাড়তে থাকে, সে অবস্থাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।

মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদের সংজ্ঞাঃ

ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা বলেন যে, অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধিই হলো মুদ্রাস্ফীতি।

কেইন্সের মতে, পূর্ণ নিয়োগ অবস্থার পর অর্থের চাহিদার চেয়ে, অর্থের যোগান বৃদ্ধি পেলে তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলে।

অধ্যাপক স্যামুয়েলসনের মতে, “দ্রব্যসামগ্রী এবং উৎপাদনের উপাদানসমূহের দাম যখন বাড়তে থাকে, সাধারণতভাবে তখন তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।

অধ্যাপক হট্রের মতে, “অত্যধিক অর্থের প্রচলনকে মুদ্রাস্ফীতি বলে।”

অর্থনীতিবিদ ক্রাউথার বলেন, “মুদ্রাস্ফীতি হলো এমন এক অবস্থা যখন অর্থের মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পায় এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।”

অধ্যাপক পিগুর মতে, “যখন আয় সৃষ্টিকারী কাজ অপেক্ষা মানুষের আর্থিক আয় অধিক হারে বৃদ্ধি পায়, তখনই মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।”

অর্থনীতিবিদ কুলবর্ন এর মতে, “মুদ্রাস্ফীতি হলো এমন পরিস্থিতি যেখানে অত্যধিক পরিমাণ অর্থ অতি সামান্য পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রীর পশ্চাতে ধাবিত হয়।”

মুদ্রাস্ফীতির প্রকারভেদ বা ধরণ | মুদ্রাস্ফীতি কেন হয়?

মুদ্রাস্ফীতি প্রধানত দুটি কারণে হয়ে থাকে:

  • চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি এবং
  • মূল্য জনিত মুদ্রাস্ফীতি

এ দুটি ধরণই কোন দেশের অর্থনীতিতে মূল্য বৃদ্ধির জন্য সমানভাবে দায়ী। কোন পণ্যের চাহিদা যখন গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়ে তখন “চাহিদা জনিত” কারণে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। আবার পণ্যের সরবরাহ ব্যয় বেড়ে গেলে তখন মূল্য জনিত মূল্যবৃদ্ধি হয়।

চাহিদা জনিত মূদ্রাস্ফীতি কী এবং কেন হয়?

দ্রব্যের বা পণ্যের ক্রমশ দাম বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হলো চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি। দ্রব্যের জন্য ভোক্তার চাহিদা যখন সরবরাহের তুলনায় অতিরিক্ত হয় তখন চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। চাহিদা মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টির কারণ হলো –

  • মানুষের হাতে যখন অতিরিক্ত পরিমাণ  অর্থ চলে আসে তখন তার তার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। মজুরি বা বেতন বৃদ্ধিও মুদ্রাস্ফীতির বড় কারণ।
  • সরকার যদি বিভিন্ন কারণে বেশি করে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে, এতে বাজারে মুদ্রার আধিক্য দেখা যায় অথচ জিনিসপত্রের যোগান না বাড়ায় পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যায়।
  • দেশে কালোবাজারির পরিমাণ অতিরিক্ত হলে জিনিসের দাম অধিক বেড়ে যায়। বাংলাদেশ  এবং ভারতে প্রায় সময়ই খাদ্য শস্যের মুদ্রাস্ফীতি  দেখা যায়, এর অন্যতম কারণ হলো কালোবাজারি।
  • অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধিও অন্যতম কারণ।
  • সরকারের খরচ বৃদ্ধি। যার ফলে  সেই টাকাটা জনগণের পকেটে আসে।
  • প্রয়োজনের অতিরিক্ত “ফিসকাল স্টিমুলাস” বা অর্থনৈতিক ভর্তুকি দিলে জিনিসের দাম বাড়ে।
  • সরকারের বৈদেশিক বাণিজ্যিক ঋণ বাড়লে।

মূলত মুদ্রাস্ফীতি মানেই হলো অনেক টাকা বাজারে ঘুরছে। এজন্য  (ডলারের সাপেক্ষে) টাকার মান কমবে।টাকার মান কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায়লেই টাকা ছাপাতে পারবে না

সুতরাং বলা যায় যে, গ্রাহকরা ব্যয়যোগ্য অতিরিক্ত অর্থ আয় করেন তখন চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।

সুতরাং, গ্রাহকরা যখন অতিরিক্ত ব্যয় যোগ্য  অর্থ  আয় করেন তখন চাহিদাজনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। অর্থাৎ মানুষের হাতে ব্যয় করার জন্য বেশি অর্থ থাকলে তখন মানুষ আরও দ্রব্য কিনতে চায় এবং তাদের সেই ক্ষমতা থাকে।

মূল্য জনিত মূদ্রাস্ফীতি কি? মূল্যজনিত মুদ্রাস্ফীতি কেন ঘটে?

বাজারে যখন পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়, কিন্তু ভোক্তাদের অতিরিক্ত চাহিদার সৃষ্টি হয়, তখন সে সময়ে প্রস্তুতকারক পণ্যের দাম বাড়ানোর একটি সুযোগ পায়। যার ফলে তারা মূল্য বৃদ্ধি করে ফেলে এবং মূল্যজনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। তবে প্রধান কারণ হলো যে, কোন জিনিস তৈরি করতে যে উপাদানগুলো লাগে, তার দাম যখন বৃদ্ধি পায়, তখন সামগ্রিকভাবে দ্রব্যটির মূল্য বৃদ্ধি পায়।

কোন প্রডাক্ট বা দ্রব্য উৎপাদন করতে ৪ টি জিনিস প্রয়োজন। এগুলো হলো –

  • Land
  • Labour
  • Capital and
  • Entrepreneur

একে “ফ্যাক্টর অব প্রডাকশন” বলা হয়। এই সবকিছু মিলিয়ে যে খরচটা হয়, তাকে” ফ্যাক্টর কস্ট” বলে। তবে এখানে যদি কোনো কিছুর দাম বাড়ে, তাহলে ওই ফ্যাক্টর কস্টও বাড়বে। পাশাপাশি সেই দ্রব্যটি যখন বাজারজাত করা হয় তখন তার উপর সরকার অপ্রত্যক্ষ কর চাপিয়ে দেয়।

তারপর সেটার “মার্কেট প্রাইস” নির্ধারণ করা হয়। যদি সরকার ট্যাক্স বাড়ায় তাহলেও জিনিসের দাম বাড়বে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দাম বৃদ্ধিও এর অন্যতম কারণ হতে পারে। খনিজ তেলের দাম বৃদ্ধি মানেই ট্রান্সপোর্ট বাপরি বহনের দাম বেড়ে যাওয়া। এগুলো ছাড়াও আরও অনেক কারণ রয়েছে। নিম্নে আরও কয়েকটি কারণ দেওয়া হলো –

  • শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধি।
  • একচেটিয়া বাজার সৃষ্টি করার চেষ্টা করাও মূল্যজনিত মুদ্রাস্ফীতির কারণ।
  • বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে উৎপাদনে ক্ষতিগ্রস্ত করে সাময়িকভাবে মূল্যজনিত মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করে।
  • প্রাকৃতিক সম্পদের সংস্থান হ্রাসও অন্যতম কারণ।

মূলত সরবরাহের পরিমাণ হ্রাস পেলে বাজারে একটি ঘাটতির সৃষ্টি হয়, যার ফলে মূল্যজনিত মুদ্রাস্ফীতি হয়। উৎপাদকরা তাদের পণ্যের চাহিদা মেটাতে দাম বৃদ্ধি করে।

মূদ্রাস্ফীতিতে লাভ-ক্ষতি

মুদ্রাস্ফীতির ফলে সাধারণত চাকুরিজীবী, মধ্যবিত্ত, যাদের আয় নির্দিষ্ট তারা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।অন্যদিকে এর ফলে দেনাদাররা অর্থাৎ যে ঋণ নিয়েছে সে বেশি লাভবান হয় এবং পাওনাদার বা ঋণদাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর কারণ হলো এই সময় ঋণগ্রহীতারা তাদের সম্পত্তি বা উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করে আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে আয় করে, সেই অর্থ দিয়ে তারা ঋণ শোধ করতে পারে। আবার ঋণদাতারা যে অর্থ ফেরত পায়, তার ক্র‍য় ক্ষমতা পূর্বের চেয়ে কমে যায়।

যারা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করে, তারা এই সময়ে লাভবান হয়। কারণ শেয়ারের দাম বেড়ে যায় কিন্তু যারা নির্দিষ্ট সুদের হারে গভর্ণমেন্ট সিকিউরিটি বা ডিবেনচারে বিনিয়োগ করে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব

মুদ্রাস্ফীতির কারণে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হলেও আরেক শ্রেণীর মানুষ লাভবান হয়। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদেরা বলেন যে, মুদ্রাস্ফীতির ফলে সীমিত আয়ের মানুষের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে। তবে সে দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তৎপর হয়, তাহলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। মুদ্রাস্ফীতির কারণে সাধারণত নিদিষ্ট কিছু খাত ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হয়। নিম্নে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো –

জীবনযাত্রার মানঃ মুদ্রাস্ফীতির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে অনেকেই খরচের লাগাম টেনে ধরতে বাধ্য হয়। তবে বিশেষ করে ব্যবসায়ী ও উৎপাদকরা লাভবান হয়।

স্থির ও পরিবর্তনশীল আয়ঃ যেসব চাকরিজীবীদের আয় নির্দিষ্ট বা বেতন বৃদ্ধি পায় না অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি হারের তুলনায় কম, তারা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়। এর কারণ হলো, মুদ্রাস্ফীতির ফলে তাদের প্রকৃত আয়ে পণ্য কেনার ক্ষমতা কমে যায়।

তাছাড়া পেনশন, ব্যাংক হিসাব বা সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর নির্ভরশীল স্থির আয়ের লোকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে যারা পরিবর্তনশীল আয়ের ওপর নির্ভরশীল (যেমন – ব্যবসায়ী, শেয়ারে বিনিয়োগকারী) তারা লাভবান হয়ে থাকে। কারণ মুদ্রাস্ফীতির ফলে অনেক কোম্পানির মুনাফার পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে তারা বেশি হারে মুনাফা বা লভ্যাংশ পান।

ঋণঃ মুদ্রাস্ফীতির ফলে ঋণগ্রহীতারা লাভবান হয় কিন্তু ঋণদাতারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একটি উদাহরণের মাধ্যমে সহজভাবে বলা যায় যে, মনে করুন গতবছর আসিফ তার বন্ধু ইফাদের কাছ থেকে ১০০ টাকা ঋণ নেয়। চলতি বছর মুদ্রাস্ফীতির হার হলো ৫%। তাহলে সেই ১০০ টাকার মূল্য গিয়ে দাঁড়াবে ৯৫ টাকায়। তাই আসিফ পরের বছর ইফাদকে অর্থ ফেরত দিলেও সেটার ক্রয়ক্ষমতা ৫ টাকা কমে যায়।

আমদানি-রপ্তানিঃ মুদ্রাস্ফীতির ফলে মুদ্রার মূল্যও হ্রাস পায়। তবে রপ্তানি মূল্যের কোন পরিবর্তন হয় না। উদাহরণ – যুক্তরাষ্ট্র গতবছর বাংলাদেশ থেকে ১০০০ ডলারে ৫ টি পণ্য নিতে পারতো। কিন্তু টাকার মান কমে যাওয়ায় তারা ওই ১০০০ ডলার দিয়ে ৭/৮ টি পণ্য কিনতে পারবে।

আবার মুদ্রার মান হ্রাস পাওয়ায় অন্য দেশ থেকে আমদানির পরিমাণ কমে যায়। কারণ ওই একই পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি খরচ করতে হয়। এতে করে আমদানি নির্ভর দেশগুলোকে ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

উৎপাদন ও কর্মসংস্থানঃ মুদ্রাস্ফীতির ফলে কাঁচামালের মূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে সামগ্রিক উৎপাদন খরচের উপর এর প্রভাব বেশি পড়ে। যার ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ অবস্থায় উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। উৎপাদন কমে গেলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কা থাকে।

গোপন মজুদঃ মুদ্রাস্ফীতি অব্যাহত থাকার আরেকটি কারণ হলো পণ্যের মজুদ রাখা। কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছে, যারা উৎপাদন না বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের জন্য গোপনে পণ্য মজুদ করে রাখে। ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। যার ফলে নিম্ন আয়ের লোকেরা বেশি ভোগান্তিতে পড়ে।

এগুলো ছাড়াও মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে আরও অনেক কিছু ঘটে থাকে।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায় কী?

মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণ হলো অর্থের মূল্য বেড়ে যাওয়া। অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন জানান যে, অর্থের পরিমাণ কমালে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। এক্ষেত্রে তিনি দেশের মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলেছেন।

মুদ্রানীতিঃ বাজারে অতিরিক্ত মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিয়ে থাকে, সেই ব্যাংক হার বাড়াতে পারে। এতে করে অন্য ব্যাংকগুলো তাদের সুদের হার বাড়িয়ে দেবে। এর ফলে নাগরিকরা ঋণ নেওয়ার হার কমাবে। এতে করে বাজারে যে অতিরিক্ত টাকা এসেছিল তা আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে সরকারি ঋণপত্র বিক্রি করে আবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য নগদ জমার অনুপাত বা সংরক্ষণ বাড়িয়ে দিয়ে ব্যাংক সৃষ্ট অর্থের পরিমাণ কমানোর জন্য চেষ্টা করে থাকে। এতে  করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক এভাবে আরও বিভিন্ন উপায়ে ব্যাংকে সৃষ্ট ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

রাজস্ব নীতিঃ সরকার কর বাড়িয়ে দিলে আয়ের পরিমাণ কমবে অথবা নতুন নতুন কর আরোপ করলে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয়ের পরিমাণ কমে যাবে। এরফলল বাজরে আসা অতিরিক্ত মুদ্রা বের হয়ে যাবে। তাছাড়া সরকারের উচিত বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে খরচের পরিমাণ কমিয়ে, বাজারে চাহিদামতো পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে উৎপাদনশীল খাতে ভর্তুকি দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা।

তাছাড়া মুদ্রাস্ফীতির সময় বাজারে পণ্যের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য আমদানির পরিমাণি বাড়ানো যেতে পারে। এতে করে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কিছুটা কমতে পারে। এ জন্য মুদ্রাস্ফীতির সময় সরকার আমদানি শুল্ক কমাতে পারে। এভাবেই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Subscribe

- Never miss a story with notifications

- Gain full access to our premium content

- Browse free from up to 5 devices at once

Must read