শব্দ কাকে বলে? উৎপত্তি, গঠন ও অর্থানুসারে শব্দের শ্রেণীবিভাগ

আজ আমরা শিখব শব্দ কাকে বলে? এছাড়াও শব্দের সকল প্রকার শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।

শব্দ কাকে বলে?

ভাষার প্রধান উপাদান হচ্ছে শব্দ। অর্থ হলো শব্দের প্রাণ। একাধিক ধ্বনির সম্মেলনে যদি কোন নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ পায় তবে তাকে শব্দ বলে। আবার বলা যায় শব্দ হলো বাগযন্ত্রের সাহায্যে বিশেষ কৌশলে উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনি সমষ্টি। অর্থাৎ এক বা একাধিক বর্ণ মিলে যখন একটি পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে তাকে শব্দ বলে।

শব্দ কাকে বলে তা আমরা জানলাম। এখন শব্দ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।

অর্থাৎ অর্থবোধক বর্ণ বা বর্ণসমষ্টিতে শব্দ গঠিত হয়। যেমন – ক,ল,ম এই তিনটি ধ্বনি একসাথে মিলে – কলম (ক+ল+ম) হয়। কলম দ্বারা লিখার একটি উপকরণকে বোঝায়। তাই এটি একটি শব্দ।

আবার মনের ভাব প্রকাশের জন্য কয়েকটি শব্দ মিলে একটি বাক্য গঠিত হয়। যেমন – মেয়েটি প্রতিদিন কলেজে আসে। এ বাক্যে মেয়েটি, প্রতিদিন, কলেজে, আসে – এগুলোর প্রত্যেকটিই এক একটি শব্দ। আবার বাক্য ছাড়া বিশেষ ভাব, বস্তু ও প্রাণী প্রভৃতি প্রকাশ করে এমন অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিও শব্দ। যেমন – আমি, তুমি, ঘোড়া, গাড়ি, সে ইত্যাদি।

পড়ুনঃ শব্দ গঠন বলতে কি বোঝ? বাংলা ভাষায় নতুন শব্দ গঠনের উপায়

শব্দের শ্রেণীবিভাগ

ভাষার সম্পদই হলো শব্দ। তাই একে শব্দসম্পদও বলা হয়। বাংলা ভাষার শব্দসমূহকে পণ্ডিতেরা প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো –

  • উৎপত্তি বা উৎসমূলক শ্রেণীবিভাগ
  • গঠনমূলক শ্রেণীবিভাগ
  • অর্থমূলক শ্রেণীবিভাগ

পড়ুনঃ মিশ্র শব্দ কি বা কাকে বলে? কয়েকটি মিশ্র শব্দের উদাহরণ

উৎস বা উৎপত্তি অনুসারে শব্দ

উৎস বা উৎপত্তি অনুসারে বাংলা ভাষার শব্দসমূহকে ৫ ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

  • তৎসম শব্দ
  • অর্ধ-তৎসম বা ভগ্ন তৎসম শব্দ
  • তদ্ভব বা প্রাকৃত শব্দ
  • দেশি শব্দ
  • বিদেশী শব্দ

তৎসম শব্দ: তৎ অর্থ “তার” আর সম অর্থ “সমান”। অর্থাৎ তৎসম শব্দের অর্থ তার সমান বা সংস্কৃতের সমান। যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে কোন রূপ পরিবর্তন ছাড়াই সরাসরি বাংলা ভাষায় এসেছে তাদেরকে তৎসম শব্দ বলা হয়। যেমন – সিংহ, পুত্র, রাজা, শিশু, মাতা, আকাশ, শিক্ষা ইত্যাদি। ড. মোঃ এনামুল হকের মতে বাংলা ভাষার 25% শব্দ তৎসম।

অর্ধ-তৎসম বা ভগ্ন তৎসম শব্দ: তৎসম মানে সংস্কৃত আর অর্ধ তৎসম মানে আধা সংস্কৃত। বাংলা ভাষায় কিছু কিছু সংস্কৃত শব্দ কিঞ্চিৎ বা সামান্য পরিবর্তিত হয়ে ব্যবহৃত হয় এগুলোকে অর্ধ-তৎসম শব্দ বলে। অর্থাৎ যেসব তৎসম শব্দ বাঙালির মুখে উচ্চারণে বিকৃতির ফলে তৈরি হয়েছে তাদেরকে অর্ধ-তৎসম বলা হয়। যেমন – কেষ্ট, গিন্নি, গেরাম,ছেদ্ধা, কিচ্ছু ইত্যাদি। ড. মোঃ এনামুল হকের মতে বাংলা ভাষার 5% শব্দ অর্ধ-তৎসম।

তদ্ভব বা প্রাকৃত শব্দ: তদ অর্থ (তা) সংস্কৃত, ভব অর্থ জাত অর্থাৎ, তদ্ভব অর্থ সংস্কৃত থেকে জাত। এটি একটি পারিভাষিক শব্দ। যেসব শব্দ সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় এসেছে সে সব শব্দ তদ্ভব শব্দ বলা হয়। একে খাঁটি বাংলা শব্দও বলা হয়। যেমন – হাত, ভাত,বলয়, গাত্র ইত্যাদি।

সংস্কৃতপ্রাকৃতবাংলা
হস্তহুথহাত
ভর্তভত্তভাত
গাত্রগাঅগা

দেশি শব্দ: আমাদের দেশের (বাংলাদেশের) আদিম অধিবাসীদের ব্যবহৃত শব্দসমূহকে দেশি শব্দ বলা হয়। অর্থাৎ, আমাদের দেশে আর্য জাতি আসার আগে যেসব জাতি বাস করত তাদের কিছু কিছু শব্দ এখনো বাংলা ভাষায় রয়েছে এগুলোকে দেশি শব্দ বলে। যেমন – ডাব, কুলা, ছড়ি, খাঁচা, পেট, চাল, লাঠি, তেঁতুল ইত্যাদি।

বিদেশী শব্দ: বিশ্বের অন্যান্য দেশের ভাষা থেকে যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে সে সব শব্দকে বিদেশি শব্দ বলে। যেমন –

আরবিঃ জান্নাত, জাহান্নাম, কলম, জিন, জামিন, জামা, নবী, রাসূল ইত্যাদি।

ফারসিঃ সুদ, খরচ, চাকরি, পোশাক, চাদর, খুব ইত্যাদি।

ইংরেজিঃ ব্যাংক, চেয়ারম্যান, স্যার, প্যান্ট, কোর্ট, টিকিট, শার্ট, অফিসার, ভিসা ইত্যাদি।

পর্তুগিজঃ জানালা,আনারস, বালতি, পাউরুটি, সাবান ইত্যাদি।

তুর্কিঃ বাবা, বন্দুক,বিবি, বেগম, দরগা,চাকু,খানম ইত্যাদি।

চীনাঃ চা, চিনি, এলাচি,তুফান ইত্যাদি।

বরমিঃ লুঙ্গি,ফুঙ্গি,কিয়াং ইত্যাদি।

হিন্দিঃ ঠান্ডা, পানি,বাচ্চা, খানাপিনা, ভরসা ইত্যাদি।

মালয়ীঃ গুদাম, সাগু ইত্যাদি।

ইন্দোনেশীয়ঃ বাতাবি বর্তমান ইত্যাদি।

গুজরাটিঃ খদ্দর, হরতাল ইত্যাদি।

রুশঃ সোভিয়েত, মেনশেভিক ইত্যাদি।

পাঞ্জাবিঃ চাহিদা, শিখ ইত্যাদি।

এছাড়া আরও বিভিন্ন ভাষার কিছু শব্দ বাংলায় রয়েছে।

পড়ুনঃ বুৎপত্তিগতভাবে / উৎস / উৎপত্তি অনুসারে শব্দ কত প্রকার ও কি কি?

গঠনমূলক শ্রেণীবিভাগ

গঠনগতভাবে শব্দকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

  • মৌলিক শব্দ
  • সাধিত শব্দ

মৌলিক শব্দঃ যেসব শব্দকে বিশ্লেষণ বা ভেঙে আলাদা করা যায় না, তাকে মৌলিক শব্দ বলে। যেমন – গোলাপ, নাক, ফল, হাত ইত্যাদি।

সাধিত শব্দঃ যেসব শব্দকে বিশ্লেষণ বা ভেঙে আলাদা করা যায়, তাকে সাধিত শব্দ বলে। যেমন – √ চল+ অন্ত = চলন্ত, বাঘ + আ = বাঘা, চাঁদ + মুখ = চাঁদমুখ ইত্যাদি।

পড়ুনঃ পারিভাষিক শব্দ বা পরিভাষা কি? এর প্রয়োজনীয়তা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ২০০ পারিভাষিক শব্দ

অর্থমূলক শ্রেণীবিভাগ

অর্থগতভাবে শব্দকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

  • যৌগিক শব্দ
  • রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ
  • যোগরূঢ় শব্দ

যৌগিক শব্দঃ যেসব শব্দের ব্যুৎপত্তিগত ও ব্যবহারিক অর্থ একই সে সকল শব্দকে যৌগিক শব্দ বলে। যেমন –

বোন + আই = বোনাই (বোনের স্বামী)

√ রাখ + আল = রাখাল (যে গরু রাখে)

ঢাকা + আই = ঢাকাই (ঢাকায় উৎপন্ন)

এছাড়াও রয়েছে গায়ক, কর্তব্য, কুম্ভকার,গাড়িওয়ালা ইত্যাদি।

রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দঃ প্রত্যয় এবং উপসর্গ দ্বারা গঠিত যেসব শব্দের বুৎপত্তিগত ও ব্যবহারিক অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা সেসব শব্দকে রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ বলে। যেমন –

হাত + ই = হাতি (বুৎপত্তিগত অর্থ হাত আছে যার কিন্তু তা না বুঝিযে হাতি বলতে প্রাণীকে বোঝায়)

জ্যাঠা + আমি= জ্যাঠামি (বুৎপত্তিগত অর্থ জ্যাঠার মতো না বুঝিয়ে চাপল্য বোঝায়) ইত্যাদি।

যোগরূঢ় শব্দঃ সমাস দ্বারা গঠিত যেসব শব্দের বুৎপত্তিগত ও ব্যবহারিক অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা সেসব শব্দকে যোগরূঢ় শব্দ বলে। যেমন –

পঙ্কজপ্রকৃত অর্থ যা পঙ্কে জন্মেব্যবহারিক অর্থ পদ্ম
জলদপ্রকৃত অর্থ যা জল দেয় ব্যবহারিক অর্থ মেঘ
সরোজপ্রকৃত অর্থ যা সরোবরে জন্মেব্যবহারিক অর্থ পদ্ম

তাহলে আজ এখানেই থাকলো। শব্দ কাকে বলে? উৎপত্তি, গঠন ও অর্থানুসারে শব্দের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আর্টিকেলটি ভালো লাগলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।

13 thoughts on “শব্দ কাকে বলে? উৎপত্তি, গঠন ও অর্থানুসারে শব্দের শ্রেণীবিভাগ”

  1. থ্যাঙ্কু আপু সুন্দর উপস্থাপনার জন্য। জাজাকুমুল্লাহু

  2. সাদিয়া

    আপু, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমিও ঢাবিতে পড়ি।পরিভাষা সম্পর্কে একটা পোষ্ট দিলে অনেক উপকার হতো। 23 তারিখ এক্সাম। তার আগেই পারলে দিয়েন।

    1. ইসরাত জাহান কে জানানো হইছে আপু। শীঘ্রই দেওয়ার চেষ্টা করবে❤

    2. পরিভাষা নিয়ে লিখা আছে একটা, আপু। পারিভাষিক শব্দ বা পরিভাষা কি? এর প্রয়োজনীয়তা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ২০০ পারিভাষিক শব্দ। এটা সার্চ দেন।

  3. ইসরাত জাহান আপু
    লেখালেখির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

    1. Lutful Al Numan

      আপনার জন্যও দোয়া রইলো ভাই। অনেক অনেক ধন্যবাদ

  4. আব্দুল আহাদ

    আপু সুন্দর উপস্থাপনার জন্য ধন্যবাদ ।

  5. Faysal Ahmmed

    এতো সুন্দর করে উপস্থাপন করার জন্য ধন্যবাদ ইসরাত জাহান আপুকে ❤️

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *