ব্যাকরণ এমন উপায় যা বাক্য তৈরি করার জন্য শব্দগুলোকে একসাথে যুক্ত করে। অর্থাৎ এটি একটি কাঠামোগত বিষয়। এটি প্রাকৃতিক ভাষায় ধারা, বাক্যাংশ এবং শব্দের সমন্বয়কে পরিচালনা করে থাকে।
প্রতিটি ভাষারই ৪ টি মৌলিক অংশ রয়েছে। এগুলো হলো-
- ধ্বনি
- শব্দ
- বাক্য ও
- অর্থ
ধ্বনিগুলো কীভাবে উচ্চারিত হবে, শব্দগুলো কীভাবে গঠিত হয়, শব্দগুলোর রূপান্তর কীভাবে ঘটে এবং এই চারটিকে বাক্যে কীভাবে সাজানো বা বিন্যস্ত করা হবে এসব বিশ্লেষণ, বর্ণনা করে দেখানোর চেষ্টা থেকেই মূলত ব্যাকরণের উদ্ভব হয়েছে।
ব্যাকরণ কাকে বলে?
ব্যাকরণ কাকে বলে? ব্যাকরণ হলো ভাষার সংবিধান। এটি সংস্কৃত শব্দ। এটিকে বিশ্লেষণ করলে পাই, বি + আ + √কৃ + অন। শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ বিশেষভাবে বিশ্লেষণ। ব্যাকরণে ভাষার অভ্যন্তরীণ নিয়ম বা শৃঙ্খলা বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। অর্থাৎ যে শাস্ত্রে কোন ভাষার বিভিন্ন উপাদানের প্রকৃতি ও স্বরূপের বিচার বিশ্লেষণ করা হয় এবং বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক নির্ণয় ও প্রয়োগবিধি বিশদভাবে আলোচিত হয় তাকে ব্যাকরণ বলে।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “যে বিদ্যার দ্বারা কোন ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপ আলোচিত হয় এবং পড়ায়,লেখায় ও কথাবার্তায় তার শুদ্ধ প্রয়োগ করা হয়, সে বিদ্যাকে সে ভাষার ব্যাকরণ বলে।”
ড. মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর মতে, “যে শাস্ত্রে কোন ভাষার বিভিন্ন উপাদানের প্রকৃতি ও স্বরূপের বিচার বিশ্লেষণ করা হয় এবং বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক নির্ণয় ও প্রয়োগবিধি বিশদভাবে আলোচিত হয়, তাকে ব্যাকরণ বলে।”
ড. হুমায়ুন আজাদের মতে, “এখন ব্যাকরণ বা গ্রামার বলতে বোঝায় এক শ্রেণীর ভাষা বিশ্লেষণাত্মক পুস্তক যাতে সন্নিবিষ্ট হয় বিশেষ বিশেষ ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগের সূত্রাবলী।”
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, “যে শাস্ত্র জানলে ভাষা শুদ্ধরূপে লিখতে, পড়তে ও বলতে পারা যায়, তাকে ব্যাকরণ বলে।”
ড . এনামুল হকের মতে, “যে শাস্ত্রের দ্বারা ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া ইহার বিবিধ অংশের পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয় করা যায় এবং ভাষা রচনা কালে আবশ্যকমত সেই নির্ণীত তত্ত্ব ও তথ্য প্রয়ােগ সম্ভবপর হইয়া উঠে , তাহার নাম ব্যাকরণ।”
ব্যাকরণের ইতিহাসঃ
১৭৩৪ সালে ঢাকার ভাওয়ালে পুর্তুগিজ পাদ্রি মনোএল দ্য আসসুম্পসাঁও প্রথমবারের মতো বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন । প্রথম রচিত এ বাংলা ব্যাকরণের নাম ছিল, পুর্তুগিজ ভাষায়ঃ ‘ভোকাবুলারিও এম ইদিওনা বেনগলিয়া, ই পর্তুগিজ: দিভিদিদো এমদুয়াস পার্তেস’। পরবর্তীতে ১৭৭৮ সালে ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড ইংরেজিতে বাংলা ব্যাকরন রচনা করেন । এই ব্যাকরণের নাম ছিলঃ ‘A Grammar of the Bengali Language’. এই গ্রন্থটিকে উইলিয়াম কেরি ১৮১৮ সালে আবার সমৃদ্ব করে রচনা করেন
রাজা রামমোহন রায় প্রথমবারের মতো বাঙালি হিসেবে পূর্নঙ্গ ব্যাকরন রচনা করেন এবং তার রচিত গ্রন্থটির নাম ‘ গৌড়ীয় ব্যাকরণ’। বর্তমানে আমরা ব্যাপক অনুশীল করে থাকি ড. সুনীতিকুমার চট্রোপাধ্যায়ের রচিত ব্যাকরণ গ্রন্থ ‘ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গলা ব্যাকরণ’(১৯৩৯) এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচিত ‘ব্যাকরণ পরিচয়’ (১৯৫৩)।
আরও পড়ুন – বাক্য কি বা কাকে বলে? গঠন ও অর্থ অনুসারে বাক্যের প্রকারভেদ
বাংলা ব্যাকরণ কি বা কাকে বলে?
যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপাদানের গঠনপ্রকৃতি ও স্বরূপ বিশ্লেষিত হয় এবং এদের সম্পর্ক ও সুষ্ঠু প্রয়োগবিধি আলোচিত হয়, তাই বাংলা ব্যাকরণ।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, “যে শাস্ত্র পাঠ করিলে বাঙ্গালা ভাষা শুদ্ধরূপে লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারা যায়, তাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।”
ড. মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর মতে, “যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপাদানের গঠনপ্রকৃতি ও স্বরূপ বিশ্লেষিত হয় এবং এদের সম্পর্ক ও সুষ্ঠু প্রয়োগবিধি আলোচিত হয়, তা-ই বাংলা ব্যাকরণ।”
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “যে ব্যাকরণের সাহায্যে বাংলা ভাষার স্বরূপটি সব দিক দিয়া আলোচনা করিয়া বুঝিতে পারা যায় এবং শুদ্ধরূপে (অর্থাৎ, ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে যে রূপ প্রচলিত সেইরূপে) ইহা পড়িতে ও লিখিতে এবং ইহাতে বাক্যালাপ করিতে পারা যায়, তাহাকে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বলে।”
ড. সুকুমার সেনের মতে, “যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার স্বরূপ, প্রকৃতির বিচার ও বিশ্লেষণ এবং যে শাস্ত্রে জ্ঞান থাকলে বাংলাভাষা শুদ্ধরূপে বলতে, লিখতে ও শিখতে পারা যায়, তাকে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ সংক্ষেপে বাংলা ব্যাকরণ বলে।”
ব্যাকরণের কাজ
ব্যাকরণের কয়েকটি কাজ নিম্নে আলোচনা করা হলো –
- ভাষার নিয়ম নীতি আলোচনা করা
- ভাষার বিশ্লেষণ করা
- ভাষার সৌন্দর্য সৃষ্টি করা
- ভাষা প্রয়োগের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
- ভাষা ও সাহিত্যের রস গ্রহণে সাহায্য করে
- ভাষার শিল্প সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।
ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা
- ব্যাকরণ পাঠ করে ভাষার বিভিন্ন উপাদানের গঠন প্রকৃতি ও সেসবের সুষ্ঠু ব্যবহার বিধি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায।
- এর মাধ্যমে লেখায় ও কথায় ভাষা প্রয়োগের সময় শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ধারণ সহজ হয় ।
- যেকোন ভাষার শুদ্ধাশুদ্ধি নিরূপণের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- একটি ভাষারর স্বরূপ বা প্রকৃতি জানার ক্ষেত্রে এটি প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
- ভাষার প্রমিত বানানরীতি জানতে হলে এটি পাঠ করা আবশ্যক।
- শব্দ গঠন,বাক্য গঠন, ব্যবহারবিধি ও শব্দের সঠিক অর্থ নিরূপণ ইত্যাদির জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- এর সাহায্যে ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা করা যায়।
- ভাষা লেখার জন্য যেমন বর্ণের প্রয়োজন, বর্ণ ও ধ্বনিগুলোর সঠিক চর্চা, স্থাপন ও বানান বিধি ব্যাকরণ পাঠের মাধ্যমে জানা যায়।
- কবিতা ও গানের ছন্দ ও অলঙ্কার জানার জন্য এটি পাঠ করা আবশ্যক।
- সাহিত্যের দোষ, গুণ, রীতি অলঙ্কার সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করে সাহিত্যের রসাস্বাদন করতে হলে এটি পাঠ করা অপরিহার্য।
- এটি ভাষার সংবিধান বা দলিল। তাই ভাষা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভের জন্য এটি পাঠ করা আবশ্যক।
এককথায়, ভাষাকে শুদ্ধরূপে বলতে, লিখতে ও অনুধাবন করতে হলে ব্যাকরণ পাঠ করা অপরিহার্য।
পড়ুন- পারিভাষিক শব্দ বা পরিভাষা কি? এর প্রয়োজনীয়তা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ২০০ পারিভাষিক শব্দ
ব্যাকরণের প্রকারভেদ
ড. সুকুমার সেন ব্যাকরণকে ৩ ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
- বর্ণনামূলক ব্যাকরণ
- ঐতিহাসিক ব্যাকরণ
- তুলনামূলক ব্যাকরণ
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ব্যাকরণকে ৪ ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো –
- বর্ণনামূলক ব্যাকরণ
- ঐতিহাসিক ব্যাকরণ
- তুলনামূলক ব্যাকরণ
- দার্শনিক-বিচারমূলক ব্যাকরণ
ব্যাকরণের পরিধি বা আলোচ্য বিষয়
প্রত্যেক ভাষারই ৪ টি মৌলিক অংশ থাকে। যথাঃ-
- ধ্বনি
- শব্দ
- বাক্য
- অর্থ
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ব্যাকরণের পরিধিকে ৫ টি ভাগে ভাগ করেছেন। যথাঃ-
- ধ্বনি প্রকরণ
- শব্দ প্রকরণ
- বাক্য প্রকরণ
- ছন্দ প্রকরণ ও
- অলঙ্কার প্রকরণ।
সব ভাষার ব্যাকরণেই প্রধানত চারটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এগুলো হলো –
- ধ্বনিতত্ত্ব
- শব্দতত্ত্ব বা রূপতত্ত্ব
- বাক্যাতত্ত্ব বা পদক্রম এবং
- অর্থতত্ত্ব
এছাড়া অভিধানতত্ত্ব ছন্দ ও অলংকার প্রভৃতিও ব্যাকরণের পরিধি বা আলোচ্য বিষয়। নিচে ব্যাকরণের আওতা বা পরিধি বা আলোচ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো।
পড়ুন – ভাষা কি বা কাকে বলে? ভাষার বৈশিষ্ট্য
ধ্বনিতত্ত্বঃ ধ্বনি, ধ্বনির উচ্চারণ, উচ্চারণের স্থান, ধ্বনির প্রতীক বা বর্ণের বিন্যাস, ধ্বনিসংযোগ বা সন্ধি, ধ্বনির পরিবর্তন ও লোপ, ণত্ব ও ষত্ব বিধান ইত্যাদি ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।
শব্দতত্ত্ব বা রূপতত্ত্বঃ শব্দের প্রকার, পদের পরিচয়, শব্দ গঠন, উপসর্গ, প্রত্যয়, বিভক্তি, লিঙ্গ, বচন, সমাস, ধাতু,শব্দরূপ, ক্রিয়া প্রকরণ, ক্রিয়ার কাল, ক্রিয়ার ভাব, শব্দের ব্যুৎপত্তি ইত্যাদি শব্দতত্ত্ব বা রূপতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।
বাক্যাতত্ত্ব বা পদক্রমঃ বাক্য, বাক্যের অংশ,বাক্যের প্রকারভেদ, বাক্য বিশ্লেষণ, বাক্য পরিবর্তন, পদক্রম, বাগধারা, বাগবিধি, বাক্য সংকোচন, বাক্য সংযোজন, বাক্য বিয়োজন, বিরাম চিহ্ন বা যতিচ্ছেদ ইত্যাদি বাক্যাতত্ত্ব বা পদক্রমের আলোচ্য বিষয়।
অর্থতত্ত্বঃ শব্দের অর্থবিচার, বাক্যের অর্থবিচার,অর্থের বিভিন্ন প্রকারভেদ যেমন – মুখ্যার্থ,গৌণার্থ,বিপরীতার্থ ইত্যাদি অর্থতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।
ছন্দপ্রকরণঃ ছন্দের প্রকার ও নিয়মসমূহ এখানে আলোচিত হয়।
অলঙ্কার প্রকরণঃ অলঙ্কারের সঙ্গা, প্রকার ইত্যাদি বিষয়ে এখানে আলোচিত হয়।
যা যা জানা প্রয়োজন
১. ব্যাকরণ কোন ভাষার শব্দ?
- আরবি
- বাংলা
- হিন্দি
- সংস্কৃত
২. ব্যাকরণকে কী বলা হয়?
- ভাষার সংবিধান
- ভাষার বিচার
- ভাষার অঙ্গ
- ভাষার বিশ্লেষক
৩. বাংলা ব্যাকরণের প্রধান আলোচ্য বিষয় কয়টি?
- ৩ টি
- ৪ টি
- ৫ টি
- ২ টি
৪. ব্যাকরণের মূল ভিত্তি কি?
- ভাব
- ভাষা
- ধ্বনি
- বাক্য
৫. বাংলা ব্যাকরণ প্রথম কে রচনা করেন?
- ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
- মি.সি.এন.বি. হ্যালহেড
- ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়
- উইলিয়াম কেরি
৬. ব্যাকরণের কাজ কি?
- ভাষার বিশ্লেষণ
- ভাষার নিয়ম শৃঙ্খলা
- ভাষার নিয়ম নীতি
- ভাষার উন্নতি
৭. ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীতে বর্তমানে বাংলা ভাষার স্থান কততম?
- চতুর্থ
- পঞ্চম
- ষষ্ঠ
- সপ্তম
৮. প্রশ্নঃ ব্যাকরণ শব্দটির ব্যুৎপত্তি কি?
- বি + আ + কৃ + অন
- বি + আ + √কৃ + অন
- ব + আ + কি + অন
- ব + আ + কৃ + আন
৯. সন্ধি ব্যাকরণের কোন অংশের আলোচ্য বিষয়?
- ধ্বনিতত্ব
- শব্দতত্ব
- অর্থতত্ব
- রূপতত্ব
১০. প্রকৃতি ব্যাকরণের কোন অংশের আলোচ্য বিষয়?
- ধ্বনিতত্ব
- শব্দতত্ব
- অর্থতত্ব
- রূপতত্ব
উওরগুলো আপনারা কমেন্টের মাধ্যমে জানান।
তাহলে আজ এখানেই শেষ করছি। ব্যাকরণ কাকে বলে? ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এই আর্টিকেলটি ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ।