HomeUncategorizedপরিবার কাকে বলে? পরিবারের প্রকারভেদ ও গুরুত্ব

পরিবার কাকে বলে? পরিবারের প্রকারভেদ ও গুরুত্ব

পরিবার একটি মৌলিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। মানুষ হিসেবে সবাই কোন না কোন পরিবারের সদস্য। এর মাধ্যমেই আমরা জন্মগ্রহণ করি, বড় হই, নিজেও পরিবার গঠন করি এবং মৃত্যুবরণ করি। চলুন তাহলে পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।

পরিবার কাকে বলে

পরিবার কাকে বলে?

পরিবার (Family) হলো মানুষের সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের এক বিশ্বজনীন (Universal) রূপ। পৃথিবীতে মানুষের সমাজ যতদিনের পরিবারের অস্তিত্বও ঠিক ততদিনের। পরিবারের একক কোনো সংজ্ঞা পাওয়া কঠিন। পরিবারের সংজ্ঞা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে মত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে পরিবারকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

পরিবারের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Family. যা ল্যাটিন শব্দ Familia থেকে এসেছে।

পরিবার একটি প্রাচীনতম সংগঠন। সাধারণত স্বামী-স্ত্রীর যৌন সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে এই সংগঠন গঠন করে এবং সন্তান সন্তনাদি উৎপাদন ও লালন পালনের মাধ্যমে তার অস্থিত্ব ধরে রাখে।

সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার ও পেজের মতে, “সুস্পষ্ট জৈবিক সম্পর্কের দ্বারা সৃষ্ট সুনির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠী হলো পরিবার যা সন্তান সন্ততির জন্মদান এবং লালন-পালনের একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান।

সমাজবিজ্ঞানী Nimkoff বলেছেন, “Family is a union of husband & wife with or without children.”

কিংসলি ডেভিস বলেছেন, “পরিবার হচ্ছে এমন কতগুলো ব্যক্তির দ্বারা গঠিত গোষ্ঠী, যারা পরস্পর রক্তের সম্পর্কে আবদ্ধ এবং সে সূত্রে তারা একে অন্যের আত্মীয়।”

পরিবারের সাধারণ ধারণা

সাধারণভাবে পরিবার বলতে বোঝায় কতিপয় ব্যক্তির সমষ্টিকে যারা একত্রে বসবাস করে এবং যাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও আন্তরিক সম্পর্ক বিরাজ করে।

বিবাহ, রক্ত সম্পর্ক ও আত্মীয়তা সূত্রের বন্ধনে আবদ্ধ একটি সামাজিক গোষ্ঠী হলো পরিবার। পরিবার হলো অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, আন্তরিক ও মুখোমুখি সম্পর্কযুক্ত (Face to face relationship) একটি মৌলিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। যেখানে পরিবারের বাইরের কোনো ব্যক্তিরা স্থান পায়না।

তবে দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে পরিবার বহির্ভূত ব্যক্তিকে পরিবারের অন্তর্ভূক্ত করা হয়ে থাকে। তখন সেই ব্যক্তি আর অন্য পরিবারের সদস্য থাকে না, হয়ে যায় নতুন পরিবারের অংশ

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রতিনিয়ত পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া (Interaction) চলতে থাকে। প্রত্যেক পরিবারের নিজস্ব আদর্শ, ঐতিহ্য, প্রথা থাকে যা সেই পরিবারের সদস্যরা বজায় রাখে, সযত্নে লালন করে ও সে অনুযায়ী তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।

পরিবারের ধারণা বিচার বিশ্লেষণ করে বলা যায়, নারী-পুরুষের বিবাহের মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তিতে সন্তান প্রজনন ও বংশ রক্ষার আকাঙ্ক্ষা থেকে পরিবার গঠিত হয়; তাই পরিবারকে একটি জৈব একক (Biological Unit) বলেও অভিহিত করা যায়।

পড়ুন – পরিবেশ কাকে বলে? পরিবেশ কত প্রকার ও কি কি?

পরিবারের প্রকারভেদ

পরিবার প্রধানত ৬ প্রকার।এগুলো হলো –

  1. স্বামী-স্ত্রীর সংখ্যার ভিত্তিতে পরিবার
  2. কর্তৃত্বের ভিত্তিতে পরিবার
  3. আকারের ভিত্তিতে পরিবার
  4. বংশ মর্যাদা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে পরিবার
  5. বিবাহোত্তর স্বামী-স্ত্রীর বসবাসের ভিত্তিতে পরিবার
  6. পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ভিত্তিতে পরিবার

স্বামী-স্ত্রীর সংখ্যার ভিত্তিতে পরিবার

স্বামী-স্ত্রীর সংখ্যার ভিত্তিতে পরিবার ৩ ধরণের। যথাঃ-

  1. একপত্নী পরিবার
  2. বহুপত্নী পরিবার
  3. বহুপতি পরিবার

একপত্নী পরিবারঃ একজন পুরুষ যদি একজন স্ত্রী গ্রহণ করে পরিবার গঠন করে, তবে তাকে একপত্নী পরিবার বলে।

বহুপত্নী পরিবারঃ যখন একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে পরিবার গঠন করে, তখন তাকে বহুপত্নী পরিবার বলে।

বহুপতি পরিবারঃ একজন স্ত্রী যখন একের অধিক স্বামী গ্রহণ করে পরিবার গঠন করে, তখন তাকে বহুপতি পরিবার বলে।

কর্তৃত্বের ভিত্তিতে পরিবার

কর্তৃত্বের ভিত্তিতে পরিবার ২ প্রকার।

  1. পিতৃতান্ত্রিক বা পিতৃপ্রধান পরিবার
  2. মাতৃতান্ত্রিক বা মাতৃপ্রধান পরিবার

পিতৃতান্ত্রিক বা পিতৃপ্রধান পরিবারঃ যে পরিবারের কর্তৃত্ব পিতা,স্বামী বা অন্য কোন পুরুষের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়, তাকে পিতৃতান্ত্রিক বা পিতৃপ্রধান পরিবার বলে।

পড়ুন – পানি দূষণ কি বা কাকে বলে? পানি দূষণের কারণ ও রোধের উপায়

মাতৃতান্ত্রিক বা মাতৃপ্রধান পরিবারঃ যে পরিবারের কর্তৃত্ব মাতা, স্ত্রী বা অন্য কোন নারী সদস্য দ্বারা পরিচালিত হয়, তাকে মাতৃতান্ত্রিক বা মাতৃপ্রধান পরিবার বলে।

আকারের ভিত্তিতে পরিবার

আকারের ভিত্তিতে পরিবার ৪ ধরণের। এগুলো হলো –

  1. একক বা অনু পরিবার
  2. যৌথ পরিবার
  3. বর্ধিত পরিবার

একক বা অনু পরিবারঃ স্বামী, স্ত্রী ও তাদের অবিবাহিত সন্তান নিয়ে যে পরিবার গড়ে উঠে তাকে একক বা অনু পরিবার বলে।

যৌথ পরিবারঃ এ ধরণের পরিবারে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি,মাতা-পিতা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, ভাইয়ের সন্তান- সন্ততি এমনকি স্ত্রীর ভাই-বোন, পিতা – মাতা সহ একত্রে বসবাস করে।

বর্ধিত পরিবারঃ যে পরিবারের ৩ পুরুষ তথা বাবা, মা, দাদা-দাদি, চাচা-চাচী, সন্তান -সন্ততি সবাই মিলে বসবাস করে, তাকে বর্ধিত পরিবার বলে। এক কথায় তিন পুরুষের পরিবারকে বর্ধিত পরিবার বলে।

বংশ মর্যাদা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে পরিবার

বংশ মর্যাদা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে পরিবার ২ প্রকার। যথাঃ

  1. পিতৃসূত্রীয় পরিবার
  2. মাতৃসূত্রীয় পরিবার

পিতৃসূত্রীয় পরিবারঃ যে পরিবারে পিতার মাধ্যমে সন্তানের পরিচয় নির্ধারিত হয় এবং সন্তান পিতার বংশ পরিচয়ে বড় হয়, তাকে পিতৃসূত্রীয় পরিবার বলে।

মাতৃসূত্রীয় পরিবারঃ যে পরিবারে মাতার মাধ্যমে সন্তানের পরিচয় নির্ধারিত হয় এবং সন্তান মাতার বংশ পরিচয়ে বড় হয়, তাকে মাতৃসূত্রীয় পরিবার বলে।

বিবাহোত্তর স্বামী-স্ত্রীর বসবাসের ভিত্তিতে পরিবার

বিবাহোত্তর স্বামী-স্ত্রীর বসবাসের ভিত্তিতে পরিবার ৩ প্রকার। যথাঃ

  1. পিতৃবাস পরিবার
  2. মাতৃবাস পরিবার
  3. নয়াবাস পরিবার

পিতৃবাস পরিবারঃ বিবাহের পর নতুন দম্পতি স্বামীর পিতৃগৃহে বসবাসের মাধ্যমে যে পরিবার গঠন করে তাকে পিতৃবাস পরিবার বলে।

মাতৃবাস পরিবারঃ বিবাহের পর নতুন দম্পতি স্ত্রীর মাতৃগৃহে বসবাসের মাধ্যমে যে পরিবার গঠন করে তাকে মাতৃবাস পরিবার বলে।

নয়াবাস পরিবারঃ বিবাহের পর নতুন দম্পতি স্বামী-স্ত্রীর কার পিতৃ বা মাতৃ গৃহে বাস না করে, আলাদা বসবাস করে পরিবার গঠন করে, তাকে নয়াবাস পরিবার বলে।

পড়ুন – পরিবার পরিকল্পনা কি বা কাকে বলে?

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ভিত্তিতে পরিবার

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ভিত্তিতে পরিবার ২ প্রকার। যথাঃ

  1. অন্তর্গোত্র পরিবার
  2. বহির্গোত্র পরিবার

অন্তর্গোত্র পরিবারঃ অন্তর্গোত্র পরিবারের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে অবশ্যই আপন জাতিবর্ণের মধ্যে পাত্র-পাত্রী খুঁজতে হয়। এটি আবার ২ প্রকার। যথাঃ

  • অনুলোম বিবাহ ভিত্তিক পরিবার
  • প্রতিলোম বিবাহ ভিত্তিক পরিবার

বহির্গোত্র পরিবারঃ বহির্গোত্র পরিবারের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে অবশ্যই আপন জাতিবর্ণের বাইরে পাত্র-পাত্রী খুঁজতে হয়।

পরিবারের কার্যাবলি

প্রতিটি পরিবারেরই কিছু সাধারণ একই ধরনের কার্যাবলি থাকে যা সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন। অর্থাৎ পরিবারের কিছু অপরিহার্য কার্যাবলি রয়েছে যার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়। তাই পরিবারে এসব কার্যাবলি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে এবং একটি পরিবারকে ঘিরেই এসব কাজ আবর্তিত হয় বা পরিবার এসব কাজ সম্পাদন করে। যেমন: 

  1. জৈবিক কাজ (Biological Function)
  2. মনস্তাত্বিক কাজ (Psychological Function)
  3. অর্থনৈতিক কাজ (Economic Function)
  4. শিক্ষামূলক কাজ (Educational Function)
  5. রক্ষণাবেক্ষণ কাজ (Maintenance Function)
  6. বিনোদনমূলক কাজ (Recreational Function)
  7. ধর্মীয় কাজ (Religious Function)
  8. সামাজিক নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ (Function of Social Control)
  9. সাংস্কৃতিক কাজ (Cultural Function)
  10. নিরাপত্তামূলক কাজ (ঝবপঁৎরঃরপধষ Function)
  11. রাজনৈতিক কাজ (Political Function)
  12. সামাজিকীকরণের কাজ (Function of Socialization)
  13. সামাজিক মর্যাদা বিষয়ক কাজ (Function Social Status)

পরিবারের গুরুত্ব

পরিবার হলো একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ কাঠামোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌল অঙ্গ সংগঠন। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পরিবার হচ্ছে মানব সমাজের সবচেয়ে প্রাচীন, আদি, মৌলিক ও ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠান। তাই পরিবারকে সমাজের মুখ্য বা প্রাথমিক গোষ্ঠী হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। পরিবার হলো সমাজের কেন্দ্রবিন্দু।

মানব সমাজের উষালগ্ন থেকেই পরিবারের অস্তিত্ব দৃশ্যমান হয়েছে। পরিবারবিহীন সমাজের চিত্র কল্পনা করা যায় না। আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত সব সমাজেই পরিবার দৃষ্ট হয়েছে। হয়তো এর বিবর্তন ঘটেছে, রূপ বদলেছে কিন্তু সমাজে পরিবারের স্থায়ী আসন কখনো বিলুপ্ত হয়নি; পরিবারের প্রয়োজনীয়তা ফুরায়নি। এর অন্যতম কারণ হলো মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা মানুষের বৈশিষ্ট্য। মানুষ একাকী থাকতে পারে না। স্বভাবতই মানুষ সঙ্গপ্রিয়। একে অন্যের পারস্পরিক সহযোগিতায় একত্রে মিলেমিশে বাস করতে চায় যা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট। এই সহজাত প্রবৃত্তিই মানুষকে পরিবার গঠনে ধাবিত করেছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষ পরিবারের আবহেই অবস্থান করে। 

পরিবারের মধ্যেই একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে, লালিত-পালিত হয়, বেড়ে ওঠে, শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়, কর্ম করে এবং এক সময় পরিবারের মধ্যেই সে মুত্যুবরণ করে। এমন কি মৃত্যুর পর তার শেষ কৃত্যের অনুষ্ঠান পর্যন্ত পরিবারের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। তাই বলা যায়, পরিবার একটি স্থায়ী ও সর্বজনীন (Universal) সামাজিক প্রতিষ্ঠান।


আজ এখানেই থাকলো। আর্টিকেলটি ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Recent posts

Recent comments