প্রতি বছর আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মারা এই জ্বরে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেক বেশী। এই রোগের আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অনেকের অনেক কস্টের মধ্যে দিয়ে সুস্থ্য হতে হয়। চলুন আজ আমরা ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও চিকিৎসা এবং ডেঙ্গু হলে করণীয় কি? এ নিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেই।
ডেঙ্গু জ্বর কেন হয়
একজন ব্যক্তিকে যদি ডেঙ্গু ফিভার ভাইরাস (DENV) এ আক্ত্রান্ত কোন এডিস মশা কামড় দেয় তবে মশার লালা হতে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং ডেঙ্গু জ্বর তৈরি করে । মানুষ থেকে মানুষে স্পর্শে এই ভাইরাস ছড়ায় না, মশা থেকে এটি ছড়ায়। তাই চলুন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর প্রতি আমরা সহানুভূতিশীল হয়।
ডেঙ্গু ফিভার ভাইরাস (DENV) Flaviviridae পরিবারের একটি আরএনএ ভাইরাস। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রাথমিকভাবে এডিস মশা যেমন A. aegypti A. albopictus, A. polynesiensis এবংA. scutellaris দ্বারা পরিবাহিত হয়।
পড়ুনঃ মশা তাড়ানোর ১১ টি কার্যকরী উপায়
এডিস মশা কখন বেশী কামড়ায়
উত্তর হলো দিনের বেলা, বিশেষ করে সকালে এবং সন্ধ্যায়। মূলত গ্রীষ্ম-বর্ষাকালে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। শহুরে অঞ্চলের অতিরিক্ত গরম, বৃষ্টিপাত, আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এই ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ গুলোর মধ্যে জ্বর, মাথাব্যথা এবং শরীরে ছোপ ছোপ দাগ—এই তিনটি হল ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ।
- প্রথমত ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেবার পর আবারো জ্বর আসতে পারে।
- শরীরে ব্যথা
- মাথাব্যথা
- চোখে বিশেষত চোখের পেছনের দিকে ব্যথা
- মাংসপেশি, হাড় এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যথা
এসব লক্ষণ সাধারণত দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। এক সপ্তাহের মধ্যে বেশির ভাগ রোগীই সুস্থ হয়ে ওঠে। আরেকটি বিষয় জানা উচিত যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর লক্ষণ তেমন প্রকাশ পায় না। প্রতি চারজনের একজনের মধ্যে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেয়। কারও হয় মৃদু, কারও মধ্যে দেখা দেয় ভয়ানক লক্ষণ।
যেসকল প্যাথলজি পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত করা হয়
- কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট ( সি.বি.সি )
- এন এস ওয়ান এন্টিজেন NS1 AG পরিক্ষার
- ডেঙ্গু এন্টিবডি টেস্ট
যেকোন সরকারি হাসপাতাল /ভালো মানের ক্লিনিক/ ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে টেস্ট গুলো করা যায ,খরচ খুব অল্প।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
দেখুন, প্রথম কথা হচ্ছে আপনি ভয় পাবেন না। মনে সাহস রাখুন। ইনশাআল্লাহ আপনি সুস্থ্য হবেন।
- প্রাথমিক অবস্থায় বাড়ি থেকেই ডেঙ্গুর চিকিৎসা সম্ভব। এক্ষেত্রে জ্বর এবং শরীর ব্যাথা কমানোর জন্য আপনাকে প্যারাসিটামল (নাপা, এইস বড়ি) চালিয়ে যেতে হবে। উল্লেখ্য যে, চিকিৎসকরা বলছেন, প্যারাসিটামলের সর্বোচ্চ ডোজ হচ্ছে প্রতিদিন চার গ্রাম বা চার হাজার মিলিগ্রাম । কিন্তু কোন ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট এবং কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
- কুসুম গরম পানি বা নরমাল তাপমাত্রার পানি দ্বারা সারা শরীর মোছতে হবে।
- আর যেটা খুব দরকার সেটা হলো পর্যাপ্ত বিশ্রাম , জ্বর চলাকালীন আপনাকে বিশ্রামে থাকতে হবেই এমনকি জ্বরের পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত বিশ্রাম নিলে আপনি জ্বরের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
তবে অবস্থা গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে রোগীকে অবশ্যই হসপিটালে ভর্তি করে যথাযথ চিকিৎসা দিতে হবে।
ডেঙ্গু রোগীর খাবার ও পথ্য
স্বাভাবিক খাবারতো আপনাকে খেতে হবেই। এর পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার আপনাকে যথেষ্ট সুস্থ্য হতে সাহায্য করবে যেমন খাবার স্যালাইন, glucose , ভাতের মাড়, বার্লি, ডাবের পানি, দুধ/হরলিকস, বাসায় তৈরি ফলের রস, স্যুপ ইত্যাদি।
রোগীকে কখন হাসপাতালে ভর্তি করবেন
যখন ডেঙ্গু জ্বরের ভয়ানক লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করবে তখন এক মূহুর্ত দেরী না করে রোগীকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
ডেঙ্গুর ভয়ানক বিপদচিহ্নগুলো
- তীব্র পেটব্যথা
- দিনে তিনবারের বেশি বমি হওয়া
- নাক, দাঁতের গোড়া থেকে রক্তক্ষরণ
- বমি কিংবা পায়খানার সঙ্গে রক্তক্ষরণ
- শ্বাসকষ্ট
- অস্থিরতা কিংবা খিটখিটে ভাব, হঠাৎ করে আচরণগত পরিবর্তন, অসংলগ্ন কথাবার্তা
- তাপমাত্রায় বিশাল তারতম্য। জ্বর থেকে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নিচে নেমে যাওয়া; চার–ছয় ঘণ্টা ধরে প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া অথবা না হওয়া; হাত–পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
রোগিকে অবহেলা করে হাসপাতালে ভর্তি না করলে কী কী মারাত্মক সমস্যা হতে পারে
রক্তক্ষরণ বেড়ে যাতে পারে। দ্রুত রক্তের অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট) কমে যেতে পারে।, রোগীর অভ্যন্তরীণ অঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে । লিভার বড় হয়ে যাওয়া আরেকটি বিপদ। তীব্র ডেঙ্গুতে রক্তচাপ কমে যেতে পারে। যেগুলো রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবে।
হাসপাতালে ভর্তির আগে কিছু বাড়তি প্রস্তুতি
অবশ্যই বাসা থেক একটি মশারি নিয়ে যাবেন যা হাসপাতালে ব্যবহার করতে হবে। যেহেতু এডিস মশা দিনের বেলায় বেশী কামড়ায় সেহেতু রাত এবং দিনে মশারি টানাতে হবে, সেটা বাড়িতে এবং হাসপাতালে যেখানেই থাকুন না কেন। যেহেতু ডেঙ্গুতে রক্তের অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট) কমে যেতে পারে সেহতু রোগিকে রক্ত দেওয়ার দরকার পড়তে পারে । তাই রোগীর রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে একই গ্রুপের একজন রক্তদাতা আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে যে সকল ওষুধ খাওয়া নিষেধ
সব সময় ওষুধ রোগীর মঙ্গল করে এমনটা ভাবা ঠিক নয়। কিছু রোগের ক্ষত্রে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ আছে যেগুলো উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি করে বসে। তাই ,পাঠক সর্তক হউন। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে নিচের ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন-
- কিছু ব্যাথা ব্যথানাশক ওষুধ যেমন ডাইক্লোফেন, আইবুপ্রোফেন, ন্যাপারক্সেন
- এসপিরিন
- ওয়ারফারিন
- বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিত যেকোন এন্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ
প্রিয় পাঠক আপনার ডেঙ্গু জ্বর ভালো হয়ে গেলে আপনি ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে উপরের ওষুধ গুলো প্রয়োজন হলে আবার সেবন করতে পারবেন।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ করবেন কিভাবে
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের ডেঙ্গু ফিভার ভাইরাস (DENV) কে প্রতিরোধ করতে হবে আর সেটার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো এই ভাইরাসের বাহক তথা এডিস মশাকে নির্মূল করা। নিম্নোক্ত উপায়ে আমরা ডেঙ্গুকে প্রতিরোধ করতে পারি-
- বাড়ির সামনে কোনরকম পানি জমতে দেবেন না। বাড়ির সামনে কথায় পানি জমে থাকলে টা পরিস্কার রাখার চেষ্টা করুন। জমা পানি ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত এডিস মশার বংশ বিস্তারের অনুকুল পরিবেশ তৈরি করে।
- এডিস মশার কামড় এড়ানোর জন্য দিনে এবং রাতে ঘুমাবার সময় আবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন ।
- বাচ্চাদের ঢিলা ঢালা ফুল হাতা জামা প্যান্ট পরিয়ে রাখুন।
- ঘরে মশা মারার ঔষধ বা কয়েল ব্যবহার করুন।
- ঘরবাড়ির ভেতরে ফুলের টবে এবং অন্য কোথাও পানি জমতে দেওয়া দিবেন না। আশে পাশে কোনরকম আবর্জনা জমতে দিবেন না, বসবাসের চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে যেন মশার বংশবিস্তার রোধ হয়।
তথ্যসূত্রঃ
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও চিকিৎসা এবং ডেঙ্গু হলে করণীয় কি? আর্টিকেলটি লিখার জন্য যেসব জায়গা থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছেঃ